ঘুম বিষয়ক উপাখ্যানমালা

 ঘুম বিষয়ক উপাখ্যানমালা
—বিভাবসু
১.
যে মেঘ আমাকে উপহাস্য করে তুলেছিলো অশান্ত এক সমুদ্রের কাছে
যে আকাশ আমাকে করুণাহীন বাষ্পের মতো ভাসিয়েছিলো অসীমতায় 
যে হাওয়া আমাকে নরম আগুনের পাশে এনে হুড়মুড় করে পরিয়ে দিয়েছিলো শিখা
আর যে মেয়ে আমাকে টেনে নামিয়েছিলো কারণহীন অতলের চিটচিটে অহংকারে
তাদের নম্রতার মধ্যে, তাদের রঙিন শুশ্রূষার মধ্যে এই আমার পরমায়ু 
আরো আরো অসুস্থ মানুষের পালে ভিড়ে গিয়ে ছুঁয়ে দিয়েছিলো অচ্ছুত বৈরাগ্য 
আর অখণ্ড তেজের মধ্যে ভাসিয়ে দিয়েছিলো দাম্ভিক আলো 
আজ তাদের অবিশ্রাম করুণার মধ্যেই হেঁটে হেঁটে পেরিয়ে যাবো দীর্ঘ দীর্ঘ সব বালিয়াড়ি 
তাদের অবিশ্রাম কামনার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে যাবো আমার ঘুমশাসিত হৃদয় 
তাদের অসীম দৃষ্টির মধ্যে ঝরে পড়ুক বকুল বকুল সব ভোরবেলা—

২.
কোথাও যখন আর বিশ্বাসতাড়িত ছুটে যাওয়া থাকে না
শুধু অন্ধকারকে কেন্দ্র করে নেচে চলে শববাহী কুয়াশারা
আর তাদের ভয়ঙ্কর হিঁ হিঁ, ভেঙে পড়তে থাকে অজানা অচেনা সব পাখির পালকে
তখনও একটা হলুদ পোয়াতিকান্না জেগে থাকে অনেক দূরের কোনো নক্ষত্র-গহ্বরে
আর তার সমস্ত ম্লানতা ঘিরে ঝিকঝিক করতে থাকে পরিদের ডানার আলোয়ান 
এই তো চতুর্দিকে ফুরিয়ে যাচ্ছে মানুষের নীলাভ আয়ুর ছায়া
আর কোনো দীপদান জ্বলবে না জেনে আগুনের সাথে স্বপ্নের কী ভীষণ নিষ্প্রভ খেলা 
এইতো ছুটে আসছে পালপাল অন্ধকার—তাদের ঘিরে শববাহী কুয়াশাদের ভয়ঙ্কর হিঁ হিঁ
শুধু কোথাও আর বিশ্বাসতাড়িত ছুটে যাওয়া নেই—
শুধু কোথাও আর এক বিন্দু ভালোলাগার বুদবুদ নেই—

৩.
নামতে নামতে নেমে আসা ততদূরে, যতদূর মানুষের দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে 
নামতে নামতে নেমে আসা ততদূরে, যতদূর মানুষের মৃত্যুর দরোজা
তোমাকে কীভাবে বোঝাই, এই আমার দৃষ্টিপথ আগলে থাকে ঘৃণা,
আমার সমস্ত নৈকট্যগুলো বিষিয়ে থাকে শোকবিহ্বলতায় 
এরওপর মাটির গন্ধ থেকে ছিনেজোঁক কিলবিল করতে থাকে যখন
তখন, তোমার জন্য নির্মাণ করি কোনো অমল শোকগাথা!
যখন সবুজ প্রজন্মগুলো ঘুমিয়ে থাকে স্নায়ুর বিকলনে
তোমাকে কীভাবে বোঝাই এই আমার দৃষ্টিপথ জুড়ে আর কোনো প্রশস্ত বারান্দা থাকে না তখন 
নামতে নামতে নেমে আসা ততদূরে, যতদূর মানুষের দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে 
নামতে নামতে নেমে আসা ততদূরে, যতদূর মানুষের মৃত্যুর দরোজা

৪.
আমাদের পরাজয়ের চিহ্নবাহী সেই লাজুক ভেড়ার পালে আজ একটাও 
উৎসাহী নীল রং উড়ছে না। একটাও আকাশ অস্বাভাবিক মেঘের মতো ঢলে গিয়ে 
নেমে আসছে না আদুরে ভঙ্গিতে।
যখন জানালা-কপাটগুলো খুলে যেতে যেতে জেগে উঠছে এক প্রথাবিহীন দুর্গনগরী 
তখনো পিলপিল করে হেঁটে যাচ্ছে না কোনো অক্লান্ত সেবাদাসের কাফেলা 
আর তোমার জটিল মনোরোগ কেন যে উদাসী হচ্ছে না পুবের হাওয়ার মিড়ে
আমাদের জয়ের চিহ্নবাহী হলুদরেশমের সেই ভেড়ারপাল নেমে আসছে সমতলে—
সময় গড়ে তুলছে এক নিরেট নির্ভার জগৎ। সেখানে বেদনাচর্চিত সব প্রেমের উপাখ্যান 
হয়ে উঠছে সবুজ কচি কচি ঘাস—আর প্রশান্ত ঘুমের কোরাস।

৫.
বৃষ্টির মেয়েরা সব নাচলো হাত ধরাধরি করে। গান গাইলো অবিরাম নীলের ধারায়
আর একটা ভিনদেশি পুরুষ ক্লান্ত হাত মেলে, ভিক্ষে চাইল একফোঁটা অধর
সে কী লজ্জা আর সে কী অদ্ভুত পুলকে নেচে গেল মুষলধারার এই গ্রামবাংলা
থেমে গেল আনন্দযজ্ঞের সেই ঝমঝম। নতমুখে বৃষ্টির মেয়েরা
ফিরে গেল ঘরে। অন্দরে হাসির কলরোল তুলে ডুবে গেল শীতের ওপারে

৬.
আড়ালে আবডালে তার এতোটুকু জোছনা ছিলো না, যতোটুকু তরল ছিলো কাঙ্ক্ষিত 
যতোটুকু জ্যোতি ছিল তার হাত, ততটুকু নিঃশ্বাসবায়ু শুধু পাহারা দিচ্ছিলো আকাশের নীল 
আর শেষতম স্রোতের পিঠে ফিরে আসছিলো সাদা সাদা ঘুমের ওষুধ 
আমাদের একা হয়ে যাওয়া সমস্ত ডাকবাংলোর হলুদ রোগের খোঁজে 
আড়ালে আবডালে তার এতোটুকু জোছনা ছিলো না, এতোটুকু হুলস্থুল ছিলো না 
শুধু লাল লাল বাদামপাতার ঢেউয়ে ফিরে আসছিলো কামনাসিক্ত হাওয়ার মেয়েরা
তারা ভাসিয়ে দিচ্ছিলো সব নেশাতুর কাঠের রেলিং আর ক্ষয়রোগা জানালার শিক
তবু সেই চাঁদের মহিমাহীন রাত্রির উদাসী ঠোঁটে, আরো এক করুণ জোলো হাওয়ায়,
কারা যেন আমার হারানো ঘুমের পাশে, হুটহাট মেলে দিচ্ছিলো রমণীয় আগুন 
কারা যেন গেয়ে যাচ্ছিলো জাগানিয়া গান—পেঁচার ডাকে সে ছিলো ভয়ানক বেসুরো সময়
কোন এক হিমের দেশে, যখন আড়ালে আবডালে আর এতোটুকু জোছনা ছিলো না লুকানো
নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন